-
|
প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
|
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তিন জেলা রাঙ্গামটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি সম্মিলিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে পরিচিত। মোট ১৩২৯৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এর অবস্থান। এর ৭৪% জমি পাহাড়ি জমি, ৬% সমতল জমি এবং ২০% এবড়ো থেবড়ো জমি। এখানে চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরং, চাক, বম, লুসাই, খুমি, ত্রিপুরা, খেয়াং, পাংখোয়া ও বাঙ্গালীসহ নানান জাতিসত্ত্বার মানুষ বসবাস করে। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসী কৃষিজীবি। দূর্গম এলাকা, সেচের পানির অভাব, অনুন্নত কলা-কৌশল এ এলাকার কৃষিকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারেনি। তাই শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এখনও অনেক পিছিয়ে এ এলাকার অধিবাসীগণ।
পার্বত্য অঞ্চলে সবধরণের ফসল চাষাবাদ করা যায় না। অনুন্নত ব্যবস্থাপনার কারণে ফসলের ফলন কম হয়। ইক্ষু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি নতুন অর্থকরী ফসল। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকয় কৃষির সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এ অঞ্চলে ইক্ষু চাষ একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় লাভজনক ফসল। ইক্ষু প্রতিকূল আবহাওয়া যেমন খরা, অতিবৃষ্টি, ঘন কুয়াশা, ঝড়ো বাতাস ইত্যাদি অবস্থার মধ্যে টিকে থাকতে পারে। যা ধান, সবজি ও অন্যান্য ফসল টিকে থাকতে পারে না। ইক্ষুর সাথে সাথী ফসল চাষ করে একই জমি থেকে বছরে দুই-তিনটি অতিরিক্ত ফসল পাওয়া যায়। সাথী ফসল কৃষকের নিজের পরিবারের চাহিদা মেটানোর পরে উদ্ধৃত্ত অংশ বাজারে বিক্রয় করে নগদ অর্থ পাওয়া যায়। সাথী ফসল হিসাবে উৎপাদিত সবজি, তেলবীজ, মসলা ও ডাল জাতীয় ফসলের পরিবারের আংশিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। ইক্ষু পরিপক্কতা অর্জনের পরেও ফসল দীর্ঘদিন ক্ষেতে রেখে কৃষক আস্তে আস্তে বিক্রয় করতে পারে যা অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গুড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদার অধিকাংশই দেশের অন্য এলাকা থেকে এনে পূরণ করা হয়। এই গুড় ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ও ভেজালযুক্ত হওয়ায় জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্বাস্থ্যসম্মত ইক্ষুর গুড় উৎপাদন করে এই এলাকার গুড়ের চাহিদা পূরণ ও উদ্ধৃত্ত গুড় দেশের অন্যান্য স্থানে সরবরাহ করা সম্ভব। এর ফলে এ অঞ্চলে জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও জীবন মানের উন্নয়ন ঘটবে।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইক্ষু ও সাথী ফসল চাষ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সম্প্রসারণ কার্যক্রম নেই। এ সকল ফসলের উৎপাদন প্রযুক্তি বিশেষ করে উন্নত ইক্ষু বীজ উৎপাদন ও কৃষকদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা নেই। সমতলের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইক্ষুর ফলন প্রায় তিনগুন হলেও সম্প্রসারণের কার্যক্রম অপ্রতুলতা এবং প্রযুক্তি প্রয়োগের অভাবে এ অঞ্চলে ইক্ষুর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। গুড় উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি ও গুড় সংরক্ষণ প্রযুক্তি সম্পর্কেও কৃষকদের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) ইক্ষু ও গুড় উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে কাজ করছে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ইক্ষু ও সাথীফসল চাষ করে কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং ব্যাপকভাবে উন্নত মানের গুড় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আরও বৃহত্তর কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রয়োজন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপকভাবে তামাক চাষ হয়। সর্বনাশা তামাকের আগ্রাসন ক্রমশ: বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইক্ষুর তুলনায় তামাক চাষে লাভ কম হলেও তামাক কোম্পানীগুলো এ অঞ্চলের গরীব কৃষকদের মাঝে কিছু নগদ অর্থ ও উপকরণ বিতরণ করে তাদেরকে তামাক চাষের প্রতি আকৃষ্ট করছে। তামাক চাষ মাটির উর্বরতা শক্তি বিনষ্ট করা ছাড়াও পরিবেশ, বন ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তামাক কিউরিং এর জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে মূল্যবান বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রতি একরে উৎপাদিত তামাক পাতা কিউরিং এর জন্য কমপক্ষে ৫ মে: টন জ্বালানী কাঠ প্রয়োজন হয়। তামাক কিউরিং এর ফলে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস মানবজীবন ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। পার্বত্য অঞ্চলে ইক্ষুই একমাত্র ফসল যা তামাক চাষকে সাফল্যজনকভাবে প্রতিস্থাপন করতে পারে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় প্রতি হেক্টর তামাক চাষ করে যেখানে নীট আয় দাঁড়ায় ২,২৭,১৭০ টাকা (সংযোজনী-৯ দ্রষ্টব্য) সেখানে উন্নত পদ্ধতিতে চিবিয়ে খাওয়া ইক্ষু আবাদ করলে প্রতি হেক্টরে নীট আয় হয় ৪,২৩,৫৩০ টাকা। এ তথ্য হতে পরিস্কার বুঝা যায় তামাক চাষের চেয়ে ইক্ষু আবাদ লাভজনক। উপরন্তু সাথী ফসল চাষ করে এ আয় আরও বৃদ্ধি করা যায়। উন্নত জাত ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব, উন্নত ইক্ষু জাত স্বল্পতা এবং দূর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা এ এলকায় কম ইক্ষু চাষাবাদের প্রধান কারণ। গবেষণা-প্রদর্শনীর মাধ্যমে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ, পরিচ্ছন্ন ইক্ষু বীজের সরবরাহ এবং ইক্ষু প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনার শক্তিশালীকরণ এ এলাকার ইক্ষু চাষাবাদ বাড়িয়ে দিতে পারে বহুলাংশে।
এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) এর তত্ত্বাবধানে জুলাই, ২০০৬ খ্রি. হতে জুন, ২০২০ খ্রি. মেয়াদে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু চাষ সম্প্রসারণের জন্য পাইলট প্রকল্প’ শীর্ষক একটি প্রকল্প সীমিত আকারে এ এলাকায় বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পটি পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বেড়েছে বাণিজ্যিক ইক্ষু চাষ। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০০৫-২০০৬ অর্থ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩ জেলার রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে মোট ১০৮৫ (প্রায়) হেক্টর জমিতে ইক্ষু চাষ হতো। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু চাষ সম্প্রসারণের জন্য পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বর্তমানে ইক্ষু আবাদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০৭০ হেক্টরে (প্রায়)। গত কয়েক বছরে অবিরাম প্রচেষ্টায় কৃষক পর্যায়ে অধিক উৎপাদনশীল বিএসআরআই আখ ৪১ (অমৃত), বিএসআরআই আখ ৪২ (রংবিলাস), চায়না, ভিয়েতনাম, ভিএমসি ৮৬-৫৫০, বনপাড়া গেন্ডারী, মধুমালা, রনাঙ্গন, সিও ২০৮ প্রভৃতি ইক্ষু জাত পৌছানো সম্ভব হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার কৃষক ও মহিলাসহ সর্বস্তরের মানুষ উন্নত প্রযুক্তিতে আখ চাষ করে সাবলম্বী হওয়ার পথ পেয়েছে। অথচ অদ্যাবধি তিন পার্বত্য জেলায় বিএসআরআই এর কোন স্থায়ী দপ্তর স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ফলে দূরত্বের কারণে বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) প্রধান কার্যালয়, ঈশ্বরদী, পাবনা হতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সবসময় চাহিদামত ইক্ষু বীজ সরবরাহ করা সম্ভব হয়না। এছাড়া কৃষকের সাথে যোগাযোগ, সকল কার্যক্রম সময়মত সার্থকভাবে সম্পন্ন করা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। সে জন্যেই এ এলাকার অধিবাসীদের কার্যকর সেবাদান অব্যাহত রাখার নিমিত্তে তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি উপকেন্দ্র স্থাপন অত্যন্ত জরুরী।
বর্তমান সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারভূক্ত কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করেছে। ফলে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো তিন পার্বত্য জেলায় কৃষি কার্যক্রম আরও জোরালো, নিবিড়ভাবে পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করার জন্য নানানমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আশার বিষয় হলো ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ইক্ষু ও অন্যন্য সুগারক্রপ আবাদের কর্মপরিধি আরও সম্প্রসারিত হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সরকারি উদ্যোগে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, উন্নত ইক্ষু বীজ সরবরাহ, বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা এবং এ খাতে কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার কৃষকদের ইক্ষু চাষে আগ্রহ বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রুত সফলতা পাওয়া যাবে। এই এলাকায় গুড় উৎপাদন বৃদ্ধি করে গুড়ের চাহিদা পূরণ করা যাবে। গুড় উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে দেশে চিনি আমদানির পরিমাণ হ্রাস পাবে। ফলে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আধুনিক ইক্ষু চাষাবাদ প্রযুক্তি এবং ইক্ষুর সাথে সাথী ফসল আবাদ সম্পর্কিত বিষয়ে কৃষক এবং মাঠ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে প্রযুক্তিটি দ্রুত বিস্তারের মাধ্যমে একই জমি থেকে অধিক পরিমাণ ইক্ষু উৎপাদন করা সম্ভব হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত উন্নত ইক্ষু জাত চাষাবাদ, প্রদর্শনী প্লট স্থাপনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান, দারিদ্র বিমোচন ও পুষ্টিমান উন্নয়নে সহায়ক হবে। ইক্ষু চাষাবাদের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় উৎপাদিত ইক্ষু হতে স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নতমানের গুড় তৈরি, গুড় সংরক্ষণ ও বিপণনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান এবং আয় বৃদ্ধির নিশ্চিত করা যাবে। তিন পার্বত্য জেলার জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, পতিত জমি সদ্ব্যবহার, পুষ্টিমান উন্নয়ন এবং তামাক ফসলের বিকল্প অর্থকরী ফসল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রস্তাবিত প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
|